আলফাডাঙ্গা উপজেলায় তেমন কোন দর্শনীয় স্থান নাই, তবে মধুমতি নদীর গতিপ্রকৃতি ও আলফাডাঙ্গার সবুজ প্রকৃতি খুবই দর্শনীয়। এ ছাড়া আলফাডাঙ্গায় বিষ্ণুপাগলের আস্তানা, বুড়াইচ ও চাঁদড়া জমিদার বাড়ী,বুড়াইচ নীলকুঠি, বানা বাজার মসজিদ ও শিরগ্রামের রাধা-গোবিন্দ মন্দির এখানকার সুন্দর যায়গা।
এ ছাড়া নিম্নে উল্লিখিত স্থানগুলো খুবই দর্শনীয়।
আলফাডাঙ্গা উপজেলার দর্শনীয় স্থানসমূহঃ
১) মীরগঞ্জ নীলকুঠিঃ
অষ্টাদশ শতকে মধূমতি, বারাশিয়া, চন্দনা প্রভৃতি নদীর তীরবর্তী উর্বর জমিতে নীল চাষ করা হত। আলফাডাঙ্গার মীরগঞ্জে তখন প্রধান কুঠি স্থাপন করা হয়েছিল। এই কুঠির অধীনে ৫২টি কুঠি ছিল। কুঠি ঘিরে গড়ে উঠেছিল বিশাল বাজার। প্রধান ম্যানেজার ছিলেন ডানলপ। নীল কর ডানলপ চাষীদের বাধ্য করে নীল চাষ করতে থাকেন। নীল চাষে নিরুৎসাহীদের নীল কুঠিতে ধরে এনে অমানবিক অত্যাচার করা হতো। জানা যায় এক বিঘা জমিতে নীল উৎপাদন ৮ থেকে ১২ বান্ডিল। ১০ বান্ডিলের মূল্য ছিল ১ টাকা। এই টাকা থেকেও কৃষকদের সামান্য কিছু দেওয়া হতো। পক্ষান্তরে নীলকরেরা নীল রপ্তানী করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করত। প্রতিটি কুঠি নিয়ন্ত্রনের জন্য একজন ম্যানেজার থাকত। তাকে বলা হতো বড় সাহেব। বড় সাহেবের সহকারীকে বলা হতো ছোট সাহেব। দেশীয় কর্মচারীদের প্রধানকে বলা হতো নায়েব বা দেওয়ান। নায়েবের মাসিক বেতন ছিল ৫০ টাকা। নায়েবের অধীনে ছিল একজন করে গোমস্তা। গোমস্তারা বড় ও ছোট সাহেবের কথা মতো চলত। তারা কৃষকদের ধরে এনে বেত্রাঘাত করত। এ ছাড়াও সহজ সরল কৃষকের মা বোনদের কুঠিতে ধরে এনে নিযার্তন করত। এ জন্য ইউরোপিয়ানরা নীলকে কৃষকের নীল রক্ত বলে চিহ্নিত করেছে। হাজী শরীয়তউল্লাহ ও তার পুত্র দুদু মিয়া অত্যাচারী নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কৃষকদের নিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল এক লাঠিয়াল বাহিনী। এ বিদ্রোহ এক সময় গণ আন্দোলনে রূপ নেয় যা নী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৮৩৮ সালে দুদু মিয়ার নেতৃত্বে বৃটিশ নীলকরদের সাথে কৃষকদের প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ডানলপ সাহেব আউলিয়াপুর নামক স্থানে পরাজিত হন এবং দলবল নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান।
এই ডানলপ সাহেবের মৃত্যুর পর তাকে আলফাডাঙ্গার মীরগঞ্জে প্রধান কুঠির পাশে সমাহিত করা হয়। পূর্বে এখানে নীল প্রস্ত্ততের জন্য চুল্লী, লম্বা চিমনি, সিন্দুক, ছোট বড় অনেক ইত্যাদি ছিল। এখন তা ধ্বংস হয়ে মাটিতে পতিত হয়েছে। ঊনবিংশ শতকে নীলের চাষ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায় এবং মীরগঞ্জ আস্তে আস্তে জরাজীণ হতে থাকে। শেষ চিহ্ন হিসেবে পড়ে থাকে ডানলপ সাহেবে সমাধি। সম্ভাবত ২০০০ সালের দিকে কয়েকজন লোভী ব্যক্তি সমাধিতে অনেক ধন সম্পত্তি থাকতে পারে এই লোভে এক রাত্রে যন্ত্রপাতি এবং দলবল নিয়ে সমাধি ভেংগে ফেলে। দুঃখের বিষয় তারা এ থেকে কোন মূল্যবান সম্পদ পায়নি তবে কয়েকটি পাথরের বাটি পেয়েছিল বলে লোকমুখে শুনা যায়। বর্তমানে সমাধিটি কয়েক খন্ড ভাংগা অবস্থায় ঐ স্থানেই । সমাধির গায়ে পাথরে খোদাই করা বাংলা ভাষায় কিছু লেখা আজও জ্বলজ্বল করছে। সেই লেখাটুকু গুবহু নিম্নে দেয়া হলো -
অকপুট পরোপকার বিখ্যাত নীল শ্রীযক্ত য়্যানেল কেম্পবল হানলপ ............আয়ের নামক জিলার অন্তঃপতি ডন্ডন্যান্ড নগরে বাস করিয়া সন ১১৯৫ সালে বঙ্গদেশে শুভাগমন করত মিরগঞ্জ প্রভৃতি নীল কুঠিতে ৬০ ষাট বতসর পর্যন্ত অভিশয় যশঃপূর্বক স্বজীবিত কাল যাবত অতিবাহিত করিয়া সন ১২৫৫ সালে কাত্তিক ও শুক্রবারে স্বর্গ হইয়াছেন বান্ধবগণ ও বেতনভোগী ব্যক্তিগণ চিরকাল তদ্বীয় গুনগান স্মরনাথ অর্থব্যয় দ্বারা ....... স্ফোলিত পুস্তক ...... স্থাপিত করিলেন।
মীরগঞ্জ নীরকুঠি আমাদের আলফাডাঙ্গা তথা গোটা বঙ্গ দেশের অত্যাচারী নীলকরদের শোষনের এক ছোট দৃষ্টান্ত তাই আমাদের উচিত মীরগঞ্জ এর শেষ স্মৃতিটুকু রক্ষা করা তা হলে পরবর্তী প্রজন্ম জানবে বাঙলী কত শোষন নিপীড়ন সহ্য করে আজ স্বাধীনতা পেয়েছে।
২) বাজড়া নীল কুঠির ঃ
আলফাডাঙ্গা উপজেলা মধুমতি নদীর তীরে অবস্থিত বাজড়া গ্রামে নীল কুঠি স্থাপন করে। এখানকার কৃষকদের নীল চাষ করার জন্য নীলকর সাহেবরা চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। কয়েক বছর নীলচাষ করে কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। চাষীরা নীল চাষ করা বন্ধ করে দিতে গেলে নীলকর সাহেবদের লাঠিয়াল বাহিনী কৃষকদের উপর অত্যাচার শুরু করে। বাজড়া ও তার আশপাশের কৃষকরা সংগঠিত হয়ে বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহে নীলকর সাহেবদের পতন ঘটে। বাজড়া নীল কুঠির নমুনা আজও চোখের সীমানায় ধরা পড়ে।
৩) কুচিয়াগ্রাম গোল বাওড় ঃ
ষাটের দশকে মধুমতি নদীর মুল স্রোতধারা পশ্চিম দিকে সরে যাওয়ায় এ উপজেলার কুচিয়াগ্রাম নামক গ্রামে গোলাকাকৃতির বিশাল জলাশয় সৃষ্টি করে। জলাশয়টি গোলাকার আকৃতি বলে ইহাকে গ্রামের নাম অনুসারে কুচিয়াগ্রাম গোলবাওড় বলা হয়। এ ছাড়া এ উপজেলাতে বেশ কয়েকটি হাওড় বাউড় ছিল। যেমনঃ সড়ারকান্দির গজারগাড়িয়ার বিল, টিকরপাড়ার বিল, ঘিদয়ার চ্যালেনদার বিল, শুকুরহাটার রক্ষাচন্ডীর বিল, পানাইলের নাপতির ঘোপ, কুলধরের বিল, ফুলবাড়িয়া শাপলার বিল, নওয়াপাড়ার হাওড় এবং বাঁকাইলের বলার দুয়া। এক সময় এ সব বিলে চৈত্র-বৈশাখ মাসে ৭র্ - ৮র্ পানি পানি থাকত এবং এখানে প্রচুর পরিমানে সুস্বাদু দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। মোট কথা এ সব ছিল দেশীয় মাছের প্রজনন ক্ষেত্র। যার প্রেক্ষিতে এ উপজেলার মানুষের মাছের কোন ঘাটতি ছিল ন। ‘‘মাছে ভাতে বাঙলী’’ কথাটি এ উপজেলার মানুষের ক্ষেত্রে শতভাগ প্রযোজ্য ছিল। কিন্ত কালের স্রোতে একমাত্র কুচিয়াগ্রাম গোল বাওড় ব্যতিত এ উপজেলার অন্য কোন বিলে শুস্ক মৌসুমে পানি থাকে না। এ কারনে এ সব বিলের মাছের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তাই ‘‘মাছে ভাতে বাঙলী’’ কথাটি আর এ উপজেলার মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজন্য নেই। বর্তমানে কুচিয়াগ্রাম বাওড়টিতে শুস্ক মৌসুমে ৫র্ - ৬র্ পানি থাকে ও দেশীয় মাছে ভরপুর এবং উপজেলার একমাত্র দেশীয় মাছ উৎপাদনের প্রজনন ক্ষেত্র। এ বিলের উল্লেখযোগ্য মাছ হচ্ছে শিং, মাগুর, কৈ, শোল, গজার, বোয়াল, রুই, কাতলা মৃগেল,টাকি, ফুটি ও মলা মাছ প্রভৃতি। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে সরকারি ভাবে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়। গ্রামের ভূমিহীন দরিদ্র প্রায় ১০ - ১৫টি পরিবার এ বিল থেকে মাছ ধরে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। বি,এস জরিপ অনুযায়ী এ বিলের আয়তন ০৮.৫০ একর এবং বর্ষা মৌসুমে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১০০ একর হয়। এ বিলের সাথে মধুমতি নদীর একটি সংযোগ খাল ছিল। কিন্ত কিছু পরিবেশ ধ্বংসকারী স্বার্থানেষী মহল এই সংযোগ খালটি মাটি দ্বারা ভরাট করে ফেলেছে। এ কারনে বর্ষার পানি আর এ বিলে প্রবেশ করে না। বৃষ্টির পানিই বিলটির একমাত্র ভরসা। বর্ষার পানি না প্রবেশ করায় মধুমতি নদীতে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আর এ বিলে পাওয়া যায় না। যখন এ বিলের সাথে মধুমতি নদীর সংযোগ খাল চাল ছিল, মধুমতি নদীর পলি মিশ্রিত ঘোলা পানি এসে বাওড় টইটুম্বুর হয়ে যেত। বিলের চারপাশের আবাদী ফসলী জমির ধান ক্ষেত সবুজে সবুজে একাকার হয়ে যেত। বিলের পাশেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্চু বেড়ী বাঁধ থাকায় বিভিন্ন এলাকা হতে আগত প্রকৃতি প্রেমিকেরা প্রতি দিন পড়ন্ত বেলায় এই নৈসর্গিক প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য বেড়ী বাঁধে ভিড় জমাত। শুস্ক মৌসুমে ঝাকে ঝাকে বিভিন্ন প্রজাতির অথিতি পাখির কিচিরমিচির কলরবে আশে পাশের এলাকা মুখরিত হয়ে উঠত। উপজেলা প্রশাসনের কড়া নজরদারীর কারনে কেউ অথিতি পাখি শিকার করার সাহস পায় না।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS